Header Ads Widget

নামের বিড়ম্বনা

 

গল্প, নাম নিয়ে গল্প


বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু খুব ঘনিষ্ট ছিলাম। আমরা একসাথেই বেশি সময় কাটাতাম। আমরা বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়ন করলেও পড়াশোনা একসাথেই করার চেষ্টা করতাম। আমরা একেক বন্ধু একেক বিষয়ে পড়তে আগ্রহী ছিলাম।  লাইব্রেরিতে আমরা আমাদের নিজেদের পছন্দের বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করতাম। এরই ফলে হরেক রকম মজার জ্ঞানে আমাদের আড্ডাগুলোও প্রাণবন্ত হতো। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু মহলে যারা ছিল তাদের কয়েকজন হলো  রুবেল, আকরাম, অর্ক, হামিদ, বাচ্চু, ফজলু। আরো কয়েকজন বন্ধু আমাদের সাথে অনিয়মিত সময় কাটাতো। আমাদের এই ঘনিষ্ট বন্ধু মহলের বাচ্চুকে নিয়ে আমরা প্রায়ই বিরক্ত হতাম। সেও আমাদের সাথে মাঝে মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ত। আমরা ‍তার কিছু অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করতাম। আচরণটা ছিল এমন যে, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের বন্ধুদের কাউকে ডাকলে সে সাড়া দিয়ে ফেলত। আমরা কোথাও ঘুরতে বের হলে হঠাৎ করেই সে পিছনে ফিরে তাকাতো, থেমে যেতো। আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যেত। তার এই ছোট্ট সমস্যাটি ছাড়া আর কোন অস্বাভাবিক আচরণ আমাদের চোখে পড়েনি। তার এই আচরণে আমরা প্রায়ই বিব্রত হতাম। ছোট বেলায় আমি মাঝে মাঝে বড় আপার সাথে এরকম দুষ্টুমি করতাম। বড় আপা কাউকে ডাকলে, আমি তাকে রাগানোর জন্য প্রায়ই তার ডাকের উত্তর দিতাম ‘‘কী” বলে। কয়েকবার এই একই কাজ করলে, আপাও ক্ষেপে যেতো। তখনই ক্ষণিকের মধ্যেই আমি আপার চোখের সীমানা বাহিরে উদাও হয়ে যেতাম। বুঝতে পারতাম যে, তখন যদি ধরা পড়ি, আর রক্ষা নাই। কিছুটা উত্তম মাধ্যম আমি পাওনা হয়ে গেছি। বাচ্চুর আচরণে মাঝে মধ্যেই আমার এই বিষয়টা মনে পড়ে যেত। বড় আপার সাথে এমন দুষ্টুমি আচরণের কথা মনে হতেই আমার হাসি পেতো।

একদিন আমরা বন্ধুরা জ্ঞানগর্ব গল্প করার সময়ে বাচ্চুর এই অদ্ভুত আচরণের বিষয়টি উঠালাম। বাচ্চু ক্ষণিক সময় চুপ থেকে তার নাম নিয়ে বিস্তর গল্প শুরু করল। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার কথার শৈল্পিক বর্ণনা মনোযোগের সাথে শ্রবণ করছিলাম। গ্রামে গঞ্জে শীতের সময়ে ওয়াজে মাওলানারা যেভাবে “নাহমাদুহু” বলে শুরু করে, তার শুরুটা অনেকটা সেরমকই ছিল। সে প্রথমেই বলতে শুরু করেছিল:

নাম মানুষের জন্য বড় ধরণের একটা বিষয়। প্রত্যেকের জীবনে নামের একটি বিশেষ প্রভাব পড়ে। ধরো আমরা সবাই একটা ঘরে ঘুমিয়ে আছি। আমাদের কোন একজনকে কেউ নাম ধরে ডাকছে। আমাদের অনেক জনের মধ্যে শুধু যার নাম ধরে ডাকা হবে, সাধারণত সে ই শুধু ঘুম থেকে জেগে থাকে। এর মানে হচ্ছে নামের প্রভাবে ব্যক্তি জীবন গড়ে উঠে। বিভিন্ন ধরণের নাম শেখাটা জ্ঞানেরও একটা বড় অংশ। আল্লাহ যখন আদম (আ:) কে সৃষ্টি করেছেন, তখন ফেরেস্তাদের থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ আদম (আ:) কে সকল নাম শিখিয়েছিলেন। ফেরেস্তা ও আদমের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল সকল নাম বলতে পারার প্রতিযোগিতা।

আমাদের মাঝেও পড়াশোনা করতে গিয়ে যে যত বেশি ও কঠিন নাম মনে রাখতে পারে এবং সেই নামের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনা বর্ণনা করতে পারে, তাদেরকে সাধারণ আমরা বেশি জ্ঞানী বলে মনে করে থাকি।

বাচ্চু গল্প করতে করতে ভাবগাম্ভীর‌্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আমরাও পড়ন্ত বিকেলে বাচ্চুর এ কর্মশালায় মনোযোগী ছিলাম। বাচ্চু আবার বলতে শুরু করেছিল:

বিভিন্ন ধরণের নাম শিখে জ্ঞানী হওয়ার বিষয়টিতো বড়দের ব্যাপার। তার আগেই শিশু বয়সে প্রত্যেকে তাকে ডাকা নামে নিজেকে চিনতে থাকে। আত্মপরিচয়ের জন্য প্রত্যেকের নামটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চলো আমরা একটা বিষয় কল্পনা করি যে, এই পৃথিবীকে আমাদের কারো কোন নাম নাই। তাহলে বিষয়টি কেমন হতো? এমন যদি হতো, তাহলে আমরা পারস্পারিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পারতাম না। একারণেই শিশু জন্মগ্রহণের সাথে সাথে নাম রাখা হয় এবং সেই শিশু ওই নামের সাথেই নিজের মানসিকতা স্থির করে নেয়। আমরা শিশুকাল থেকে বুঝতে শেখার সাথে সাথেই নিজের নামকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল ধরণের প্রচেষ্টা চালাতে থাকি। নিজেদের নামের খ্যাতির জন্য জীবনের শেষ পর‌্যন্ত চলে আমাদের কর্মতৎপরতা। এমন দার্শনিক বক্তব্য দেয়ার পর বাচ্চু কিছুক্ষণ থেমেছিল।

আমরা তখনো বুঝতে পারিনি যে, বাচ্চুর হঠাৎ এমন তাত্ত্বিক বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য কি? আমরা সবাই বাচ্চুর আলোচনায় ভাবনার জগতে ডুব দিয়েছিলাম। তখন সে আবার বলতে শুরু করেছিল:

আমি নিজেকে কোন নামে প্রতিষ্ঠিত করব তা ভেবে পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি বাচ্চু নাকি অন্য কেউ?

একথা শুনতেই আমরা অনেক বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম। আমাদের একজন জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? তোমার নামেই তুমি বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করবে। আরেকজন বলে উঠেছিল, তুমি কি আমাদের পরিচিত বাচ্চু না? নাকি কোন জ্বিন? এই প্রশ্নটার সাথে সাথে আমাদের পরিবেশটা কিছুটা হালকা হয়েছিল। আমরা সবাই হাসাহাসি শুরু করেছিলাম। শুধু বাচ্চুই হাসছিল না। বাচ্চু আবার শুরু করছিল:

আরে, আমি জ্বিন না। বরং আপাতমস্তক একজন মানুষ। আমার মা এবং বাবার বংশের একমাত্র আদরের সন্তান আমি। আমি ছাড়া দাদা ও নানার বাড়িতে আদর পাওয়ার দ্বিতীয়জন আর নেই। যাকে বলে, আলালের ঘরে দুলাল। অতি মাত্রায় সকলের আদর আমার জন্য কিছুটা ভোগান্তিও ছিল। ভোগান্তির বিষয়টা ছিল আমার নাম রাখা নিয়ে । আমার জন্মের পরপর প্রত্যেকেই আমার জন্য আলাদা আলাদা নাম রেখেছিল। সকলেই ভালোবেসে তাদের রাখা পছন্দের নামে আমাকে ডাকত। শুধু ভালোবেসে ও আদর করে নতুন নতুন নামে ডাকলে কোন সমস্যা হতো না। সবাই তাদের রাখা নামেই আমাকে অভ্যস্ত করার জন্য আমার উপর যত কৌশল পারে তা প্রয়োগ করত।

আমার দাদা শেরে বাংলা একে ফজলুল হককে খুব ভালোবাসতেন। দাদা আমার নাম রেখেছিলেন ফজলুল হক। আত্মীয়দের মধ্যে দাদা ভক্তরা আমাকে ফজলুল হক থেকে ফজলু নামে সবাই ডাকতো।

আমার নানা ছিল মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানীর ভক্ত। নানা বাড়ি গেলে নানার দেয়া নাম আব্দুল হামিদ থেকে হামিদ নামেই পরিচিতি পাওয়া শুরু হয়েছিল।

ছোট মামা নাকি ছোট বেলায় বাংলা সিনেমার নায়ক রুবেলের খুব ভক্ত ছিল। তাই ছোট মামা আমাকে নায়ক রুবেল নামেই বড় করার তৎপরতা চালিয়েছিল। মামা আমার নাম রাখলেন রুবেল।

আমার একমাত্র চাচা ক্রিকেটার আকরাম খানকে খুব পছন্দ করত। চাচাও আমার নাম রাখলেন আকরাম খান। তিনি আমায় ডাকতেন আকরাম নামে।

আমার মা তার একমাত্র সন্তানের নাম রাখবেন না, তা কি করে হতে পারে? মা নাকি কলেজে পড়ার সময়ে তার স্যারের কাছ থেকে অর্ক নামটা শুনেছিলেন। তখন থেকেই মা তার সন্তানের নাম অর্ক রাখবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই মায়ের দেয়া নাম অর্ক নামটাই আমি বেশি ভালোবাসতাম।

বাবা এতো নামের ভীড়ে আমার আর কোন নতুন নাম রাখেননি। তিনি আমার নামের বিড়ম্বনা বাড়াতে চাননি। তিনি যখন যার পাশে থাকতেন, তার দেয়া নামেই ডাকতেন। নয়তো সবাই বাবার সাথে রাগ করত। বাবা যা করলেন তাহলো, তিনি আমাকে স্কুলে ভর্তি করার সময়ে একটা সুন্দর নাম দিয়েছিলেন। স্কুলে আমার নাম হলো আব্দুল্লাহ।

আমি ভালো গান গাইতে পারি বলে তোমরা আমাকে আইয়ুব বাচ্চুর নাম থেকে নাম দিলা বাচ্চু। তোমাদের ভালোবাসায় আমি আরেকটি নতুন নাম বাচ্চুতে অভ্যস্ত হয়েছি। আমি এতো নতুন নতুন নামের ভালোবাসা রাখবো কোথায়, তা ভেবে অস্থির হয়ে পড়ি।

আমি যখন বুঝতে শিখেছি তখন টের পেতে থাকলাম যে, আমাকে আদর করে ও ভালোবেসে প্রত্যেকের রাখা নামে যদি আমি সাড়া না দেই, তখন আমার বখশিশ ও আবদারের বিষয়গুলো আটকা পড়ে যেতো। সবাই তাদের নিজেদের নামে আমাকে পরিচয় করাতে আপোষহীন ভাবে তাদের কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে যেত। আমার সকল আত্মীয়রা যখন একসাথে হত, তখন হরেক রকম নামের ডাকে সাড়া দিতে আমি কি যে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তাম! তা বলে শেষ করতে পারব না। একেক নামে আমাকে একেকজন অভস্ত হতে বাধ্য করেছিল।

সবার দেয়া এতোগুলো নামের অনেক রকম সুবিধাও আমি পেয়েছিলাম। আমার যখন যেটা প্রয়োজন হতো, এতো গুলো রাখা নামের বরকতে তা পেয়েও যেতাম।

গল্প বলার এপর‌্যায়ে আমরা সকলেই বিস্মৃত হয়ে সবাই একই সাথে বলে উঠেছিলাম যে, ও তাহলে তোমার অদ্ভুত আচরণের রহস্য ছিল এই ঘটনা! আমাদের বন্ধু বাচ্চু এত নামের মাঝে কোন নাম বাছাই করে নিবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সেদিন কেউ দিতে পারিনি। আমরাও তার নাম নিয়ে ভীষণ বিভ্রাটে ছিলাম।

 লেখক: মো. আলমগীর




Post a Comment

0 Comments