ইউরোপীয়দের ভৌগোলিক আবিষ্কারের ফলে এবং ইউরোপীয়দের উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিদ্বন্ধীতার সময়ে মাত্র কয়েকজন বণিক ভারতে এসে দীর্ঘদিন প্রতিক্ষার প্রহরগুণে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর ভারতে তাদের প্রায় দুইশত বছরের শাসন শোষণ চালায়। ইউরোপে তখন ফরাসীদের আধিপত্য দুর্দণ্ডপ্রতাপে চলছিল। শুরু ইউরোপেই নয় বরং পুরো বিশ্ব তখন পরাশক্তি ফরাসীরেদ অধিপত্য দেখছিল। ফরাসীদের এই আধিপত্যে আঘাত করার জন্য বৃটিশদের প্রয়েোজন ছিল প্রচুর অর্থের। আর ব্রিটিশরা ভারতে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে ফরাসীদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ভারতবাসীদের উপর জোকের মত বসে সব চুষে নিয়ে ব্রিটেনকে করে সমৃদ্ধ আর ভারতকে করে ধ্বংস। ইংরেজদের ভারতে আধিপত্য বিস্তারের প্রথম প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ হলো বাংলার পলাশীর যুদ্ধে তাদের কূটকৌশলের বিজয়। এরপর তারা ধীরে ধীরে বাংলা হতে সম্রগ্র ভারতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
১৭৫৭ ॥ ২৩ জুন : পলাশীর যুদ্ধ : পলাশীর যুদ্ধে প্রহসন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছলচাতুরির মাধ্যমে নবাব সিরাজ-উদ- দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজ শাসকরা ভারতে তাদের সাম্রাজ্যের সূচনা করে। তখন থেকেই শুরু হয় ভারতবাসীদের দীর্ঘ প্রায় দুশত বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। ইংরেজ প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তখন হতেই ভারতীয়দের সংগ্রামের ইতিহাস ও শুরু হয় ।
১৭৬০ ॥ ইংরেজরা যার মাধ্যমে ভারতের ক্ষমতার রশি টানতে শুরু করেছিল সেই বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে সরিয়ে রাজসিংহাসন থেকে সরিয়ে তারই জামাই মীর কাশিমকে ক্ষময় বসায় ১৯৬০ সালে। স্বাধীনচেতা মীর কাশিমই প্রতিরোধের প্রথম মশাল জ্বালালেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। গদিতে বসেই তিনি দেখলেন যে, বাংলা সুবার কৃষক সমাজ, তাঁতী, বণিক সবাই বোফানির ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। কলবাতায় ইংরেজ বড়কর্তা জানকিটার্টকে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন:
তোমাদের কর্মচারীরা চাষী ও বণিকদের কাছ থেকে জোর জবরদস্তি করে জিনিসপত্র কেড়ে নেয়। হয় দাম দেয় না, নয়তো যা দাম তার মাত্র সিকিভাগ দেয়। তোমাদের গোমস্তরা ব্যবহার করে যেন তারাই জমিদার, তালুকদার বা মালিক।ইংরেজদের প্রতি নবাবের এমন মনোভাবের কারণে মীর কাসেম ইংরেজদের চক্ষুশূরে পরিণত হয়। যার পরিণতিতে স্বাধীনচেত মীর কাসেম বাংলার সিংহাসনচ্যুত হয় এবং ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে তার স্বাধীন চেতনার পরাজয়ে বাংলা পুরোপুরি ইংরেজদের কব্জায় চলে যায়।
১৭৬৪ ॥ ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ-দৌলা ও
দিল্লীর পলাতক বাদশাহ শাহ্ আলমের সেনাদল পরাজিত হয় ইংরেজদের কাছে। নতি স্বীকার
করলেন নবাব ও বাদশাহ্। কিন্তু হার মানলেন না মীর কাশিম। পলাতক অবস্থায় ১৭৭৭ সালে
মারা যায় মীর কাসিম। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পরাজিত সেনাপতি।
১৭৬৫ ॥ ১২ অক্টোবর গভর্নর ক্লাইভ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আলমের হাত
থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদের ফরমান লাভ করেন। অর্থাৎ সম্রাট শাহ
আলমকে বছরে ২৬ লাখ টাকা দানের পরিবর্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেয়ে গেল বাংলা,
বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের একচেটিয়া অধিকার। এ বছরই মীর কাশিমের স্থলাভিষিক্ত মীরজাফরের পুত্র নাজমুদুল্লাহর কাছ থেকে তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের
অধিকারও কেড়ে নেয়।
১৭৬৯-৭০ ॥ (বাংলা ১১৭৬) ছিয়াত্তরের মন্বন্তর : বাংলা ও বাংলা সন্নিহিত প্রদেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন-
“লোকে প্রথম ভিক্ষা করিতে লাগিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়। .....গরু বেচিল, লাঙ্গল বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করি। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী কে কেনে?... খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল। ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল। আগাছা খাইতে লাগিল। ইকর ও বন্যেরা কুকুর, ইঁদুর ও বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পালাইল, যাহারা পালাল না তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।”
কিন্তু সে বছরও (১৭৭১) ইংরেজের নীট রাজস্ব আদায় পূর্ববর্তী ষোল আনা ফসল জন্মানোর বছরের আদায়কেও ছাড়িয়ে যায়।
১৮০০॥ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ : বাংলার ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অর্থাৎ ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ইংরেজ শাসক ও তাদের রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের গরীব হিন্দু-মুসলমান চাষীরা প্রথম বিদ্রোহ করেছিল। প্রায় তিন দশক ধরে এ বিদ্রোহ চলতে থাকে। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা। তাদের নেতাদের মাঝে প্রধান ছিলেন মজনু শাহ্ ও ভবানী পাঠক। ভারতবাসীরদের জন্য উড়ে এসে জুরে বসা ব্রিটিশরা বহুগ্রাম জ্বালিয়ে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিচারে বহু গ্রামবাসীকে হত্যা করে এক দশক পরে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৭৯৮-৯৯ ॥ মেদিনীপুর ও বাঁচুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহ : মেদিনীপুর, বাঁচুড়া ও মানভূমের জঙ্গলমহলের অধিবাসী আদিম ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের স্থানীয় জমিদারশ্রেণী অবজ্ঞা ভরে চুয়ার্ড নাম দিয়েছিল। তাদের জমি কেড়ে নেয়ায় বা সাধ্যাতীত মাত্রায় নতুন কর ধার্য করায় বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ বিদ্রোহ দমনে ওয়ারেন হেস্টিংসের মত গভর্নরও ব্যর্থ হয়। ১৭৯৯ সালে বড়লাট ওয়েলেসলি চুয়ার্ড বিদ্রোহের নেতাদের ফাঁসি দিয়ে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনে।
১৭৯৩॥ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বড়লাট কর্নওয়ালিস সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিতে প্রবর্তন করছিলেনর চিস্থায়ী বন্দোবস্ত নামের নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা। এই ভূমি ব্যবস্থায় স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক সর্বনাশ ও শোষণ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল। মেহনতী চাষীর সর্বনাশ হলো এবং এক ধরনের ভূঁইফোড় জমিদার গোষ্ঠীর জন্ম হলো। এ বন্দোবস্তের পর জনগণের মাঝে সর্বত্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখা দিয়েছিল।
১৭৯৯ ॥ টিপু সুলতানের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম : দক্ষিণ ভারতে ইংরেজের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে প্রধান অন্তরায় ছিলো হায়দার আলী ও তার ছেলে টিপু। ইংরেজের শত্রু ফরাসীদের সাহায্যে টিপু আধুনিক অর্থনীতি ও সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। টিপু সুলতানের ব্রিটিশ বিরোধী প্রস্তুতিকে ইংরেজরা অবহেলা না করে তা দমনের জন্য ত্বড়িত পদক্ষেপ নেয়। পলাশীর মত টিপু সুলতানকেও পরাজিত করার জন্য ঘাতক সৃষ্টি করে তাদের সহায়তায় বড়লাট ওয়েলেসলি বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে টিপুর রাজ্য আক্রমণ করে। বিশ্বাসঘাতক এক সেনাপতির সহায়তা টিপু সুলতানের রাজধানী শ্রীরঙ্গপত্তন ইংরেজ সৈন্যরা দখল করে নেয়। আর বীরের মতো লড়তে লড়তে রণক্ষেত্রে প্রাণ দেন টিপু সুলতান।
১৭৯৯-১৮০১ ॥ পলিগার বিদ্রোহ : বর্তমান তামিলনাড়–র টিনেডেলি অঞ্চলের পলিগাররা ছিলেন সামন্ত জমিদার। যারা আটটের নবাবের আধিপত্য স্বীকার করলেও প্রায় স্বাধীন রাজার মতো শাসন কাজ পরিচালনা করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে পলিগাররা বিদ্রোহ করে। এদের মাঝে অগ্রণী ছিলেন পাঞ্জালাল কুরিচির পলিগার বীর পাঞ্জেম কাট্টাবোখান। তিনি ১৭৯৯ সালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু এখানেও ইংরেজ ঘাতকের সহায়তায় তিনি কিছুদিনের মধ্যে ধরা পড়েন। ইংরেজ বণিয়ারা তার ফাঁসি দিয়ে তাকে হত্যা করে। কাট্টাবোখান নিহত হলেও যুদ্ধ থামেনি বরং ইংরেজদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট বিদ্রোহ চলতেই থাকে।
১৮১৭-২৫॥ উড়িষ্যার পাঠক অভ্যুত্থান : ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা দখল করার পূর্বে স্থানীয় রাজারা পাঠকদের মাইনে না দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্যে ‘চাকরান’ নামক প্রচলিত প্রথার মাধ্যমে জমি দিত। ইংরেজরা ধীরে ধীরে শাসন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে ঐসব রাজাদের একে একে ক্ষমতাচ্যুত করার সঙ্গে সঙ্গে পাইকদের ‘চাকরান’ জমিও কেড়ে নেয়। ফলে পুরীর বকসী জগবন্ধুর নেতৃত্বে অধিকার বঞ্চিত স্থানীয়রা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ দমনে বিশাল ইংরেজ বাহিনী পুরী দখল করে নেয়। আক্রমণে পরাজিত হয়ে জগবন্ধু জঙ্গলে পালিয়ে যান।
১৮২৪-৩০ ॥ কিট্টরের রানী চান্নাম্মা ও সাঙ্গোলির রায়ান্নার সংগ্রাম : কর্ণাটকের বেল গাঁওয়ের কাছেই ছোট্ট বিক্টর রাজ্যের অপুত্রক রাজার মৃত্যু হলে ইংরেজরা রাজ্যটি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে। বাধা দেন বিধবা রানী চান্নাম্মা। ১৮২৫-এ শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। অসম যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও বন্দী হন এবং কারাগারেই তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিরোধ থামে যায়নি। বিদ্রোহের মশাল হাতে এগিয়ে আসেন সাঙ্গোলির চাষীর ছেলে রায়ান্না। ১৮৩০ সালের এপ্রিলে ইংরেজ ফৌজ রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। ইংরেজ বাহিনী ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে রায়ান্নাকে।
১৮২৪-৪৫॥ বিদ্রোহ : ১৮২৪ সালে মধ্যভারতের বুলন্দখন্দে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে গরীব হিন্দু-মুসলমান চাষীরা ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করে। বর্তমানে পরিচিত হরিয়ানার রোহতাক ও হিযাব জেলার জাঠ চাষীরা ১৮২৪ সালে একই ধরণের বিদ্রোহ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধ ভাবে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত সমগ্র গুজরাটে শোষক ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় বোল বিদ্রোহ। ১৮৪৫ সালে মহারাষ্ট্রের সামন্তওয়াড়ি ও কোলাপুরে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮২৯-৩৩ সালে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয়ের অধিবাসীদের দ্বারা সংঘটিত হয় খাসী বিদ্রোহ। একইভাবে ১৮৩০ থেকে ১৮৩৩ পর্যন্ত ছোটনাগপুরের বিস্তীর্ণ উপজাতি অঞ্চল জুড়ে আদিবাসী বিদ্রোহ হয়। রাঁচী থেকে মালভূমি পর্যন্ত লাখ লাখ মুন্ডা ও হো এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।
১৮৫৫ ॥ সাঁওতাল বিদ্রোহ : ইংরেজদের দু:শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে সিধু, কানু, ভৈরব প্রমুখের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাঁওতাল ইংরেজ শাসনের অবসান ও স্বাধীন সাঁওতাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৮৫৫ সালে কলকাতা মার্চ করে। কিন্তু এই কলকালতা মার্চ করে ও কোনো লাভ হয়নি, ততদিনে ইংরেজরা এদেশের মাটিতে তাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। ফলে এ বিদ্রোহ দমনের জন্য ইংরেজরা প্রায় ২৩ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করেছিল।
১৭৭১-১৮৩১॥ ওয়াহাবি আন্দোলন : ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের প্রথম একশত বছরে ব্যতিক্রম ধর্শী প্রতিরোধ সংগ্রাম ছিল ওয়াহাবি ও ফরাজী আন্দোলন। ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা বেরিলির সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১)-এর ওবাহাবি মতবাদ প্রচারের মূল কথা এমন ছিল যে, ভারতবর্ষ এখন শত্রুর দেশে পরিণত হয়েছে। ইংরেজরাই ভারতের স্বাধীনতার শত্রু এবং সমস্ত ওয়াহাবিরই কর্তব্য হলো এই বিদেশী শাসনের উচ্ছেদ ঘটানো। তৎকালীন বাংলা অঞ্চলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের ঢেউ প্রবাহিত হয়েছিল। বারাসাতের স্বরূপনগর ও বাদুড়িয়া অঞ্চলে এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন মীর নেসার আলী তিতুমীর। তিনি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। তিতুমীরের বিরুদ্ধে কয়েকবার আক্রমণ চালায় অত্যাচারী শাসকরা। প্র্রথম দিকে তিতুমীরের বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও শেষে যুদ্ধে তিমুমীরসহ ৪০ জন প্রাণ হারান ধর্মীয় চেতনায় উদ্ভূদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে। তিতুর সেনাপতি গোলাম মাসুমকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয় এবং বাকিদের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর করা হয়েছিল। ওয়াহাবি আন্দোলনে সক্রিয়দের এই দীপান্তরের মাধ্যমেই প্রথম ভারতবাসীদের আন্দামানে বন্দী হিসেবে প্রথম চালান করা হয়।
১৮৪২॥ ফরায়েজি আন্দোলন : ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী ধর্মীয় আন্দোলন গুলোর মধ্যে ফরায়েজী আন্দোলন ছিল বৃহৎ আন্দোলন গুলোর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য। ফরাজি আন্দোলন মূলত ওয়াহাবি আন্দোলনেরই সমগোত্রীয় ছিল । ১৮৪২ সালে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা দুদু মিয়া ঘোষণা দিলেন:
“পৃথিবীর সমস্ত জমির মালিক আল্লাহ। তাঁর চোখে সবাই সমান। কাজেই তাঁকে যদি মান্য করি, তবে জমিদারদের খাজনা দেবো না, নীলকর সাহেবদের নীল বুনব না, বিদেশী ফিরিঙ্গিদের রাজত্ব মানবো না”
ছোট্ট বণিক দল হতে ভারতের সর্বময় শাসনের অধিকারী হওয়া ইংরেজ রাজত্বের প্রথম একশত বছর এরকম ছোট-বড় অসংখ্য বিদ্রোহে টালমাটাল ছিল।
১৮৫৭ ॥ সিপাহী বিদ্রোহ : ভারতবর্ষে দীর্ঘ সময়ে কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সকল জনগণ কতৃর্ক মহা বিদ্রোহ নামে পরিচিত ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ। ১৮৫৭-এর মে মাসে মীরাটের সেনা ছাউনিতে প্রথম এই মহা বিদ্রোহের শুরু হয়। এরপর দিল্লীর সেনা ছাউনিতে সিপাহীদের মধ্যে ব্যাপক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তরুণ তেজস্বী সিপাহী মঙ্গল পান্ডে নামের বিপ্লবী ১৮৫৭ সালেরই ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরের ছাউনিতে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে দেন। ফলে তাকে ইংরেজরা ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করলে বিদ্রোহ আরো গতিশীল হয়ে সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লীতে বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রচারপত্রে লেখা হয়েছিল:
ইংরেজ শাসনে আমাদের দেশ স্বাধীনতা হারিয়েছে। জনসাধারণ দরিদ্র ও সর্বস্বান্ত। করভারে তারা জর্জরিত। খাদ্য ও বস্ত্রের নিদারুণ অভাব, মেয়েদের ইজ্জত পর্যন্ত বিপন্ন। ইংরেজদের অত্যাচারের কোনও সীমা নেই। দাসত্বের এই অপমান। এই যন্ত্রণা ভারতবাসী আর কতদিন সহ্য করবে?
৯ মে মিরাটের ছাউনিতে বিদ্রোহ শুরু হয়। ১১ মে বিদ্রোহী সিপাহীরা দিল্লী দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে স্বাধীন ভারতের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। ৩০ মে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে ওঠে লক্ষ্ণৌতে ও সমগ্র আওয়াদ অঞ্চলে। ৪ জুন বিদ্রোহ হয় কানপুরে। ক্রমে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে শতদ্রু নদীর দক্ষিণ থেকে বিহার পর্যন্ত। উত্তর প্রদেশ থেকে মধ্যভারত পর্যন্ত সমগ্র হিন্দি উর্দুভাষী বিরাট অঞ্চলে। অশান্ত হয়ে ওঠে সমগ্র ভারত। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত টলে ওঠে।
“ইংরেজ শাসকরা চেষ্টা করবে হিন্দু ও মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। ভাইসব। তাদের শয়তানির ফাঁদে কেউ পা দেবেন না। হিন্দুরা, মুসলমানরা, ভাইরা, সমস্ত তুচ্ছ ভেদাভেদ ভুলে স্বাধীনতার যুদ্ধে একই পতাকার নীচে ঐক্যবদ্ধ হোন।”
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা নৃশংসতার মাধ্যমে ভারতের এই স্বাধীনতার মহা বিদ্রোহকে দমন করে। কামানের মুখে হাজার হাজার সিপাহীকে বেঁধে তারপর কামান দেগে ভীবৎষ ভাবে স্বাধীনতাকামী সিপাহীদের হত্যা করা হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ শাসকরা। উপনিবেশিক শাসন বলবৎ রাখার জন্য সমগ্র উত্তর ও মধ্যভারত জুড়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় দেশপ্রেমিক জনগণকে।
বিশাল অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে পারলেও ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে, স্থানীয় ভারতীয়দের সহায়তা ছাড়া তারা বিশাল উপনিবেশ সুষ্ঠুভাবে শাসন করতে পারবে না। তাই বিশাল ভারত সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য তাদের প্রয়োজন ইংরেজি শিক্ষিত পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুসারী এবং স্থানীয় শিক্ষিত ভারতীয় ভদ্র সমাজ। ইংরেজদের সহায়তাকারী এই স্থানীয় ভারতীয় শ্রেণীর লোকজন থাকবে বিপুল দরিদ্র দেশবাসীর জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন ও ইংরেজ শাসনের অনুগত। এর ফলে ইংরেজ শাসনে সহায়ক ভারতীয় তৈরির জন্য ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক শুরু হলো নবজাগরণ। এই নবজাগরণ বা বাংলার রেঁনেয়ায় রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ঈশ্চরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবাই অবদান রাখে।
প্রাথমিকভাবে নব্য ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় সমাজ ইংরেজ শাসনতন্ত্রের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করলে ব্রিটিশরা তাদের প্রত্যাশা মাফিক ফল পেয়ে খুশিই ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর শিক্ষার আলোয় বাংলার রেঁনেয়ায় অবদান রাখা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে স্বাজাত্যভিমান, দেশাত্মবোধ দেখা দিলো। শুরু হলো সশস্ত্র বিপ্লব। মহাবিদ্রোহ দমনের পর ভারত শাসনের ভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সরাসরি ব্রিটিশ সংসদের হাতে তুলে নেয়। তখন ভারত সরকার নামক একটি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৮৫৯-৬০ ॥ নীল বিদ্রোহ : মহা বিদ্রোহের পর বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে দেখা দেয় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ। বাংলার এই বিক্ষোভ ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। নীলকর সাহেবদের বর্বরতা ও অত্যাচারের প্রেক্ষাপটে দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন-‘নীল দর্পণ’ নামক নাটক । যশোরে ১৮৩০ সালে এবং পরে ১৮৮৯-৯০ সালে বিহারের দ্বারভাঙ্গা ও চকারণে ১৮৬৬-৬৮ পর্যন্ত নীল বিদ্রোহ চলতে থাকে।
0 Comments