কছিুদনি আগে ঘুরে আসলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রাকৃতিক স্থান। শুধু আমাদের দেশে নয়, এই স্থানটি পুরো পৃথিবীর মধ্যে ম্যানগ্রোভ বন নামে পরিচিত।
সুন্দরবন!
কথা না বাড়িয়ে সুন্দরবনে বাঘ হরিণের রাজ্য থেকে ঘুরে আসি।আমরা ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যাবার জন্য কমলাপুর রেল স্ট্রেশন থেকে চিত্রা ট্রেনে যাত্রা শুরু করি। সন্ধ্যা ৭:০০ ট্রেন ছাড়ার সময় থাকলেও, ট্রেন মশাই প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় দেরি করেছিল। ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ায় আমাদের প্রিয় শিল্পী সাইদুল ইসলাম ভাইয়াকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পেয়েছি। যা আমাদের ভ্রমণ আনন্দ আরো অনেকগুণে বেড়ে গিয়েছিল। সুন্দরবন ভ্রমণে আমাদের সাথে ৪জন গুণী ব্যক্তিদের পেয়েছিলাম।
যাই হোক, আমরা পরের দিন ভোরে খুলনা পৌছে আমাদের জন্য রিজার্ভ করা নির্ধারিত লঞ্চে গিয়ে পৌছি সকাল ৭:০০ টার দিকে। লঞ্চে প্রধান পরিচালক অলী ইব্রাহিম ভাইয়ার উদ্ভোধনী কথা বলেন। এরপর সকালের নাস্তার কাজ শেষ করে লঞ্চ সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে একটু দেরি করেই। আমাদের ভ্রমণ গাইড হিসেবে ছিলেন সেজু ও শাওন নামের দুইজন তরুণ সহোদর। তারা আমাদেরকে ভ্রমণের শুরুতেই লঞ্চে ৩দিন ও ২রাত অবস্থান করার বিষয়ে অবহিত করেন। আমাদের পর্যটন স্থান ও সময়ের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেন।
আমরা খুলনার রূপসা নদী দিয়ে যাত্রা শুরু করি। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই প্রথম বারের মতো সুন্দরবন যাচ্ছি। সবার মধ্যে এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর অবস্থা বিরাজ করছে। আমাদের লঞ্চ রূপসা নদীর বুকে পূর্ণ গতিতে দক্ষিণে সুন্দরবনের দিকে এগিয়ে চলছে। লঞ্চে আমাদের নানা কর্মসূচি চলছিল। আমি প্রকৃতির সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পছন্দ করি। তাই লঞ্চের কর্মসূচির প্রতি আমার কম মনোযোগ ছিল। আমি শুধু নদীর দুতীরে মনোযোগের সাথে চোখ রাখছিলাম। তখনও পর্যন্ত আমরা খুলনা এলাকা অতিক্রম করিনি। তবু যা চোখে পড়ছিল তা ই ভালো লাগছিল। যেকোন বিষয় ভালো ভাবে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে না দেখলে, তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সুন্দরবন ভ্রমণের অনুমতি নেয়ার জন্য আমাদের গাইডরা বনবিভাগের অফিসে যোগাযোগ করার সময়ে মাঝ নদীতে লঞ্চ নোঙর করা হয়েছিল। তখন সুযোগ পেয়ে আমি ও সাইদুল ভাইয়া নদীতে লাফিয়ে গোসল শেষ করে নিয়েছি। গোসলের এসময়ে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের একটি বালতি রূপসা নদীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতির পর এখন আমাদের লঞ্চ পুরো গতিতে চলা শুরু করল। আমরা নদীর দুধারে প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। নদীর পাড়ের সারি সারি গাছ গুলো যেন আমাদের সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। লঞ্চে করে বাগেরহাট জেলা থেকেই মূলত সুন্দরবন শুরু। লঞ্চ থেকে আমাদের প্রথম দেখা প্রাণী বানর। লঞ্চ থেকে আমরা আলোচিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মংলা সমুদ্রবন্দর দেখতে পেলাম।
আমরা বিকেলে হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম পার্কে পৌছলাম। সেখানে আমরা একলাইনে করে পুরো পার্কটি ঘুরে আসলাম। আমি লাইলের প্রথম দিকে চলে আসি যেন বাঘের দেখা পাই। পার্কে প্রথম দিকে আমি কয়েকটি সুন্দরবনের হরিণ দেখতে পাই। হরিণ গুলো আমাদের দেখে গভীর বনের দিকে লুকানোর জন্য চলে গেলো। লাল কাকড়া গুলো আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গর্তে লুকানো দৃশ্যটিও ভালো লাগার মতো। আমাদের সাথে আসা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরী বনের ভিতরে বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখালেন। প্রায় ৪ থেকে ৫ তলার মতো উচু এখানের একটি ওয়াচ টাওয়ারে আমরা কয়েকজন উঠেছিলাম। পরে দেখি ওয়াচ টাওয়ারটি কাঁপুনি শুরু করেছে। আমরা লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম যে, এই ওয়াচ টাওয়ারটি সুন্দরবনের বড় বড় গাছ দিয়ে বানানো। কোন ইট সিমেন্টর পিলার নেই। ভয়ে তখন আমরা দ্রæত নামতে শুরু করি। পার্কটিতে কাঠের তৈরি পথে আমরা বনের গভীর পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু বাঘের পায়ের ছাপ ছাড়া বাঘ দেখার স্বাদ মিটলো না। বনে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, গোলপাতা, কেওড়া ইত্যাদি গাছ দেখলাম। কিন্তু কোনটা কি গাছ তা আমার পক্ষে নির্ণয় করা কঠিন হয়ে গেলো। আমাদের গাইডদের গাছগুলো নাম জিজ্ঞেস করলে, তারা ও সকল গাছের নাম বলতে পারেনি। তাই সুন্দরবনে থাকা অসংখ্য উদ্ভিদ আমরা দেখেছি বটে, কিন্তু সেগুলো নাম বলা আমাদের সকলের পক্ষেও সম্ভব না। বনটিতে জোয়ারের সময়ে পানি থাকে এবং ভাটার সময়ে পানি নেমে যায়। এপার্কটি ভ্রমণ শেষ করে লঞ্চে আবার ফিরে আসি এবং লঞ্চ চলতে শুরু করে।
সারা রাত লঞ্চ চলতে থাকে। রাতের খাবারের পর সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি জেগে আছি বাঘ দেখার অপেক্ষায়। আমি প্রায় রাত ২টা পর্যন্ত লঞ্চ চালকের সাথে বিভিন্ন গল্প করছিলাম। তখন সরু খাল দিয়ে আমাদের লঞ্চ চলছিল। নদী থেকে সুন্দরবনের ভিতরের সরু খাল গুলোর দুপাশে লাইট দিয়ে বাঘ খোজাখোজি করছিলাম। আমরা সারা দিন নদীতে বহুদূর থেকে সুন্দরবনের গাছ গুলো দেখছিলাম। কিন্তু আমি যখন রাত জেগে বাঘ খোজায় তৎপর। বাঘ দেখতে পাইনি ঠিকই, কিন্তু তখন সুন্দরবনের আসল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তৃপ্তি পেয়েছি। গাছে বসে থাকা সাদা বকগুলো যেন রাতের অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছে। খালের দুপাশের গাছগুলো যেন আমাদের গায়ে লেগে যাবে যাবে আবস্থা বিরাজ করছিল। দিনের বেলায় দূরের গাছগুলো রাতে কাছে এসে যাবার অনুভ‚তিটুকু লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আমি যেন সুন্দরবনে ভ্রমণের পুরো আনন্দ তখন পেয়ে গিয়েছিলাম। এ প্রাকৃতিক বনটিকে আমি সত্যি তখন ভালোবেসে ফেলেছি। আল্লাহর আপরূপ সৃষ্টিটি যেন আমার সাথে কথা বলছিল তখন।
রাতের বাকি সময়টুকু ঘুমালাম। লঞ্চের সাথে নিয়ে আসা ট্রলারে করে আমরা ২য় দিনের ভোরে আরো সরু খালে হরিণ দেখতে চললাম। আমরা কিছুক্ষণ চলার পর খালের দুধারে বনের প্রাণীদের দেখতে পেলাম। আমরা সবাই পিনপতন নীরবতায় বনের প্রাণী খোজা শুরু করি। হরিণ, বানর, বক, গোলপাতা গাছের ফল, নাম না জানা প্রাণী ও উদ্ভিদ দেখে আমরা মুগ্ধ হতে থাকি। এ খাল দিয়ে আমরা জামতলা সমুদ্র সৈকতে যাই। প্রায় ৪০ মিনিটের মতো বনের ভিতর দিয়ে হেটে সমুদ্র সৈকতে যাবার সময়ে বড় খোলা মাঠে হরিণের লাফা লাফা দেখতে পাচ্ছিলাম। মা হরিণ তার বাচ্চা হরিণদের দুধপান করানোর দৃশ্যটিও আমাদের কাছে আসাধারণ লেগেছে। হরিণ গুলো আমাদের দেখে বনের দিকে ছুটাছুটি শুরু করছিল। আমরা বনের ভিতরে বাঘ দেখার কৌতুহলী দৃষ্টি রাখছিলাম। আমরা জামতলা সমুদ্র সৈকতে এসে সাগরের গর্জনে নিজেরদের বিলিয়ে দিলাম। এই সমুদ্র সৈকতে সাদা ও কালো বালির ঢেউ খেলানো ছবির মতো দৃশ্য আমাদের মোহিত করেছে। সমুদ্র সৈকতের পাশেই আমরা বিশাল বিশাল গাছকে ভাঙ্গা ও উপড়ানো অবস্থায় দেখলাম। সুন্দরবনের এইগাছ গুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের দেশে বয়ে আসা বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হতে রক্ষা করে থাকে। আমরা তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম।
এরপর আমরা গেলাম কটকায়। হরিণের রাজ্য বলতে এই কটকাই। আমরা প্রায় ত্রিশজন একসাথে একপাল হরিণকে কেওড়া গাছের পাতা খাওয়ানোর চেষ্টায় সফল হই। চিরিয়াখানার হরিণ আর সুন্দরবনের হরিণের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। আমাদের সাথে একপাল হরিণের সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল খুব অল্প সময়ের জন্য। আমাদের গাইডরা জানিয়েছেন যে, পর্যটকদের এতো কাছাকাছি হরিণ সাধারণত আসে না। কটকায় এসে আমরা সুন্দরবনকে হরিণের অভয়ারণ্য উপলব্ধি করছিলাম।
কটকা থেকে আমরা কচিখালী অফিসপাড় পর্যটন স্থানটি ঘুরে আসলাম। এরপর বিকেল বেলায় আমরা কচিখালী ডিমের চরে ফুটবল খেলা ও সাগরে ঝাপাঝাপি করে গোসল করার পালা শেষ করে লঞ্চে ফিরে আসলাম।
৩য় দিন আমরা খুলনায় ফেরার পথে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ভ্রমণ করলাম। করমজলের এই স্থানটিকে অনেকে সুন্দরবনের সারাংশ বলে থাকেন। তবে এখানকার বানরগুলো বেশ ভয়ঙ্কর। বাদাম ও খাবারের জন্য পর্যটকদের গায়ে এসে পড়ে। আমরা শুনেছি যে, বানর গুলো কাউকে কাউকে নাকি আঘাত ও করে থাকে। আমাদের একজন ভাইয়াকে বানর ধরে ফেললে তিনি সামান্য ভয়ও পেয়ে গিয়েছিলেন। এখানের ওয়াচ টাওয়ারে উঠে আমি চিন্তার রাজ্যে ডুবে যাই। আল্লাহর এই বিশাল ও অপরূপ সৃষ্টির মধ্যে আমরা মানুষ কত ছোট! কিন্তু তবু আমরাই সৃষ্টির সেরা জীব। আবার আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য না করি, তাহলে তিনি আমাদেরকে সৃষ্টির নিকৃষ্ট হিসেবে গণ্য করবেন।
করমজল হতে আমরা লঞ্চে করে খুলনায় ফিরি। খুলনা হতে রাতে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। আমার ভ্রমণের সেরা একটি স্মৃতি হয়ে থাকবে সুন্দরবন ট্যুরটি।
0 Comments