Header Ads Widget

উপমহাদেশের রাজনীতিতে পলাশী যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রভাব

২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের পথ চলা শুরু হয়। পলাশীতে ইংরেজরা বিজয়ী হয়ে তারা সুচতুরভাবে বাংলার ক্ষমতা সরাসরি হাতে না নিয়ে বিশ্বাসঘাতক ও কর্দপহীন মীর জাফরকে মসনদ দান করে। কিন্তু ১৭৬০ সালেই ইংরেজরা মীর জাফরের পরিবর্তে তার জামাতা মীর কাসেমকে ক্ষমতা দান করে ও তাদের যথার্থ স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতয় ঘটার সন্দেহে তাকে আপসারণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় সরাসরি কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা করে। পলাশীর বিজয়ে রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈত শাসনের গোড়া পত্তন করে। দ্বৈত শাসনের প্রভাবে বাংলায় ঘটে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এর মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে শাসন শুরু হয়েছিল তা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব দমন এবং দিল্লির সিংহাসন দখলের মাধ্যমে কোম্পানির শাসনের সমাপ্তি হয়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ তখন নতুন ভাবে শোষণের শিকারে পরিণত হয়। তখন থেকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীন শাসিত হওয়ার মাধ্যমে এই নতুন শোষণের যাত্রা শুরু হয়। এরপরও সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ আরো ৯০ বছর ব্রিটিশ শোষণের যাতাকলে পৃষ্ঠ হয়।

 

পলাশীর ঐতিহাসিত ষড়যন্ত্রমূলক মন্তস্থ নাটক যুদ্ধের পর বণিয়া ইংরেজরা এদেশ ও উপমহাদেশে ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উপমহাদেশ শাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। অবশেষে তারা ভারতবর্ষ শাসন ও শোষণের স্বপ্ন পূরণে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। পলাশীতে সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের পর এবং সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ব পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক জটিলতায় ভরপুর ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ।

 

পলাশী যুদ্ধের পর রাজনৈতিক ভাবে এই দেশ হতে মুসলিমরা একক আধিপত্য হারিয়ে শাসক শ্রেণী হতে শাসিত শ্রেণীতে পরিণত হয়। ফলে সাধারণ প্রজা শ্রেণীর মুসলিমরা চরম থেকে চরম শোষণের শিকার হতে থাকে। পূর্বেকার সময়ে শাসিত হিন্দু সম্প্রদায় তখন থেকে ইংরেজদের সহায়তায় শাসক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে থাকে। হিন্দুরা নতুনভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগে দীর্ঘ প্রায় ৫৫০ বছর শাসিত হওয়ার প্রতিশোধ নেয়ার মত আচরণ করতে থাকে মুসলমানদের সাথে। পলাশীর যুদ্ধের প্রভাবেই মুসলমানদের কাছ থেকে ইংরেজরা ক্ষমতা গ্রহণ করে। যার ফলে মুসলিমদের সব সময়ে সন্দেহের চোখে শাসন করতে থাকে ইংরেজ কোম্পানি । মুসলমানরা যেন পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হতে পরে এবং বিদ্রোহের সুযোগ না পায় তাই কোম্পানির ইংরেজ শাসকরা হিন্দুদের প্রচণ্ডভাবে সহায়তা করতে থাকে। ইংরেজরা হিন্দুদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপকভাবে অবদান রাখলেও মুসলিমদের প্রচণ্ডভাবে শোষণ করতে থাকে। মুসলমানদের সকল কিছু থেকে পিছিয়ে রাখার ব্যবস্থায় কোম্পানি বৈষম্যমূলক ভাবে ভারত শাসন করতে থাকে। বিশেষত ইংরেজরা পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদেরকে শিক্ষায় পিছিয়ে রাখে। আবার মুসলিম জনসাধারণ পূর্বে নবাবদের কাছ থেকে যে ধরণের নমনীয় শাসন পেত তা কোম্পানির ইংরেজদের কাছ থেকে না পাওয়ার কারণে মুসলমানরা সব সময়ে ইংরেজ শাসনের বিদ্রোহের মনোভাব পোষণ করতে থাকে। মুসলমান, হিন্দু ও ইংরেজদের এমন মনস্তাত্তিক অবস্থা কোম্পানির শাসন ও ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। যার ফলে বাংলার শাসক শ্রেণীর মুসলমানরা অর্ধ মৃত জাতিতে পরিণত হতে বেশি দিন অতিবাহিত হতে হয়নি। মুসলমানরা শিক্ষার অভাবে ও রাজনৈতিক চক্রান্তে এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের ফলে সকল ঐতিহ্য, শৌর্য-বীর্য হরিয়ে ভীরু অনুগত জাতিতে পরিণত হয়।

পলাশীর আম্রকাননের ঘটনায় উপমহাদেশে ক্রমবর্ধমান ইংরেজ শাসকদের সাথে স্থানীয়দের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। ইংরেজ বণিক কোম্পানি অধিক রাজস্ব আদায়ে হরেক রকম কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। কোম্পানি কখনো শাসিতদের উন্নয়নের চিন্তা না করে তাদের স্বদেশ ব্রিটেনে এ দেশের অর্থ পাচারে ছিল সিদ্ধহস্ত। এমনি অবস্থার জন্য এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৭৮০ সাল হতে ফকির সন্যাসী বিদ্রোহ, রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ, মেদিনীপর ও বাঁচুড়ার চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), মহিশূরের টিপু সুলতানের বিদ্রোহ (১৭৯৯), পলিগার বিদ্রোহ (১৭৯৯-১৮০১), সাঙ্গোলির বিদ্রোহ, গুজরাটে বোল বিদ্রোহ (১৮৩৯-৪৫), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫), ১৮৫৭ সালের উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী সিপাহী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০) এবং কুকা বিদ্রোহ (১৮৭২) সংঘটিত হয়েছিল।

 

এই বিদ্রোহ গুলো ছাড়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অনেকগুলো আন্দোলন ইংরেজদের রাজনৈতিক শাসনের মসনদ ভীতসন্ত্রস্ত করে দিয়েছিল। ওয়াহাবি আন্দোলন ও বালাকোট যুদ্ধ (১৭৭১-১৮৩১), ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের নারিকেল বাড়িয়ার বিদ্রোহ (১৮৩১) ছিল ইংরেজ শাসনে অত্যাচারিত মুসলিমদের পক্ষে ও ধর্মীয় চেতনায় উদ্ভদ্ধ আন্দোলন।

ইংরেজরা পলাশীর ঐতিহাসিক নাটকে বিজয়ের পর উপমহাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাব বিস্তার করেছিল ষড়যন্ত্রের রাজনীতি উদ্ভবে। যা ভারতে পূর্ববর্তী মুসলিম শাসনের দীর্ঘ সময়ে পরিলক্ষিত হয়নি। ষড়যন্ত্রের ও কূটকৌশনের মাধ্যমেই ইংরেজরা পলাশীতে বিজয় লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই তারা ভারতে তাদের শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। দক্ষিণ ভারতে হায়দার আলী ও তার ছেলে টিপু সুলতান ইংরেজদের সাথে প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করতে থাকে। তাকে কোন ভাবেই পরাজিত করতে পারছিল না ইংরেজরা। তাই পলাশীর সেই ষড়যন্ত্র ই আবার বেঁছে নিল ইংরেজ বাহিনী। টিপু সুলতানের বাহিনীতে বিশ্বাসঘাতক তৈরি করে ইংরেজরা টিপু সুলতানকে পরাজিত করে দখল করে শ্রীরঙ্গপত্তন।

 

১৮৩১ সালে বালাকোটের প্রান্তরে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর মুজাহিদ বাহিনীও বিশ্বাসঘাতকদের জন্য পরাজিত হয়েছিল। ফলে ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির খেলায় স্থানীয়রা কেউ তাদের পরাজিত করতে পারেনি। মুসলিমদের দমনের জন্য হিন্দুদের সাথে, হিন্দুদের দমনের জন্য কখনোবা মুসলিমদের সাথে, আবার শিখদের দমনের জন্য মারাঠিদের সাথে, কখনোবা মারাঠিদের দমনের জন্য শিখদের সাথে ষড়যন্ত্র করতে ইংরেজরা ছিল খুবই দক্ষ। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে আমাদের যেই ষড়যন্ত্রের শাসন শিখিয়েছিল তা বর্তমান পর্যন্ত আমাদের রাজনীতিতে পরিলক্ষিত হয়ে আসছে।

পলাশীর পর বাংলা শাসনের রাজনীতিতে ইংরেজদের সরাসরি হস্তক্ষেপ শুরু হয়। পরবর্তীতে ইংরেজরা ধীরে ধীরে দখল করতে থাকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলো বোম্বাই ও মাদ্রাজ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধ(১৭৬৬-৯৯) ও ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধ (১৭৭২-১৮১৮) এ বিজয়ের মাধ্যমে দক্ষিণ ভারত দখল করে তাদের বাণিজ্য পথ সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত করে। এর ফলে কোম্পানি আরো বহুগুণে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হতে থাকে এবং ভারতের দুর্বল মোগল শাসকদের উপর একক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। একের পর এক কোম্পানি উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ (রোহিলখণ্ড, গোরখপুর ও দোয়াব অঞ্চল), দিল্লি-সিন্ধু, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর দখলের মাধ্যমে সমগ্র ভারতে ইংরেজদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের শাসন ক্ষমতা দখলে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়। ১৮৫৭ সালে বিচ্ছিন্ন ভাবে পরিচালিত সিপাহি বিপ্লব দমনের মাধ্যমে ইংরেজদের সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষমতা দখলের বাস্তব সুযোগ করে দেয় এবং দীর্ঘ প্রায় ৩৩০ বছরের মোগল শাসনের সমাপ্তি ঘটায়। মোগল সম্রাটকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে শাসিত হতে থাকে। তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষ ব্রিটিশ উপনিবেশ হতে মুক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয় পাকিস্তান ও ভারত। কিন্তু পাকিন্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে ও ব্রিটিশ শাসকদের রেখে যাওয়া ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে এই উপমহাদেশের শাসক শ্রেণী মুক্ত হতে পারেনি।

সামান্য কয়েকজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য বহরের কাছে বিশাল ভারতে শাসক হওয়ার দীর্ঘ পথের সুযোগ করে দেয় পলাশীর প্রান্তরে ষড়যন্ত্রে বিজয়ী হওয়া ইংরেজ বাহিনীকে।

Post a Comment

0 Comments